হেলাল হাফিজ: বাংলার সাহিত্যের এক অমর কণ্ঠস্বর

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৫:১২ পিএম

হেলাল হাফিজ: বাংলার সাহিত্যের এক অমর কণ্ঠস্বর

 

বাংলাদেশের আধুনিক কবিতা জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম হলেন হেলাল হাফিজ। তাঁর লেখা "এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়" এমন একটি পঙ্‌ক্তি, যা আজও অগণিত পাঠকের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। তিনি কেবল কবিতার পাঠকের কাছে নন, দেশের প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রাম, প্রেম-বিরহ, দ্রোহের সুর ধরতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর অমর কবিতাগুলো একাধিক প্রজন্মের পাথেয় হয়ে উঠেছে, যা বহু বছর পরেও পাঠকের মনে তার সুর ছড়িয়ে যাবে।

 

হেলাল হাফিজ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ দিয়েই মানুষের হৃদয়ে এক অদ্বিতীয় স্থান দখল করেন। এ গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা, বিশেষত "এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়", এক ধরনের শক্তি ও প্রেরণা জাগায়, যা পাঠককে কখনো সাহসী, কখনো অভ্যুত্থানকারী, আবার কখনো জীবনদর্শী করে তোলে। কবি হেলাল হাফিজ তাঁর কবিতার মধ্যে জীবনের নিগূঢ় দিকগুলোকে অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন, বিশেষ করে তার নিজস্ব সংগ্রামী জীবন অভিজ্ঞতা থেকে।  

১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে লেখা তার কবিতাগুলো মূলত সে সময়কার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের প্রতিফলন ছিল। এমনকি যে ব্যক্তি অতটাও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী নয়, তার মধ্যেও হেলাল হাফিজের শব্দের ক্ষমতা প্রবাহিত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর কবিতায় এক ধরনের সামাজিক সত্য ফুটে ওঠে, যা পাঠককে নিজের পরিচিত বা অচেনা দুঃখ-সুখের মাঝে ভাবতে বাধ্য করে।

 

হেলাল হাফিজের কবিতা নিছক সাহিত্যকর্ম নয়, বরং সংগ্রামের প্রতীক, ভালোবাসার সুর, বিদ্রোহের অঙ্গীকার। "অগ্ন্যুৎসব" কবিতাটি তার অন্যতম উদাহরণ, যেখানে প্রেম ও দেশপ্রেমের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে তিনি নিজের অস্তিত্বকে এক মহৎ লক্ষ্যেই সমর্পিত করেছেন।

 

তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কবিতা "নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়" তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এই কবিতার মাধ্যমে কবি গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং জাতির অধিকার নিয়ে এমন এক তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, যা সব যুগের মানুষের জন্য প্রাসঙ্গিক। এভাবেই হেলাল হাফিজ তার কবিতার মাধ্যমে সমাজের সকল দুঃখ-কষ্ট, অস্থিরতা, আক্ষেপ ও অভ্যুত্থানকে একাকার করেছেন।

 

হেলাল হাফিজের লেখালেখির পরিধি ছিল সীমিত। ২০১২ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ থেকে কিছু কবিতা যোগ করে প্রকাশিত হয় ‘কবিতা একাত্তর’, এরপর ২০১৯ সালে তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয়। এত কম সংখ্যক কবিতা লিখে এত খ্যাতি পাওয়া বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে এক বিরল ঘটনা।

 

শুক্রবার, (১২ ডিসেম্বর) হেলাল হাফিজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) দুপুর ২:৩০ নাগাদ তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। তাঁর প্রয়াণে বাংলা সাহিত্য আজ এক মহারথীকে হারাল, কিন্তু তাঁর লেখা কবিতাগুলি চিরকাল বাঁচবে। 

 

হেলাল হাফিজের কবিতা সবার কবিতা হয়ে ওঠেছে, কারণ তাঁর লেখা প্রতিটি শব্দ এমন এক শক্তি ধারণ করে যা কেবল সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং আমাদের সামাজিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।